‘ব্যবিলনীয় ও মিশরীয়রা, হিব্রু ও হিন্দুরা, পারসি, গ্রীক, রোমান ও টিউটনরা এবং আরও অনেক, অর্থাৎ সুপরিচিত সভ্য জাতির সবাই শুরুর পর্ব থেকে নানা কাব্য, গাথা, কিংবদন্তী ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের জাতীয় বীরদের-পৌরাণিক রাজকুমার ও রাজা, ধর্মপ্রতিষ্ঠাতা, সাম্রাজ্যে স্থপতি, সভ্যতার বা নগরীর জনক-গরিমা বিভূষিত করতে শুরু করে। এঁদের নিয়ে বীরপূজা আজও পর্যন্ত সব সমাজেই চলে আসছে। এঁদের আসনচ্যূত করা নিয়ে ঐতিহাসিকদের কোন মাথাব্যথা নেই। বরং তাঁর কাজ কিংবদন্তীর উপাদান থেকে আরাধ্য বীরদের সত্যিকারের ইতিহাস ছেঁকে বার করে আনা। একথাও প্রায় বলা যায় যে, বীরপূজার বাড়-বাড়ন্তের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা, বিশেষত যদি তা অতীতের হয়, ঐতিহাসিকদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। উপকথা যখন অস্বাস্থ্যকর চড়ামাত্রায় পৌঁছয় বা বিকৃত হতে শুরু করে তখন উপযুক্ত সন্ধানী তথ্য-সহকারে হস্তক্ষেপ করাও ঐ দায়িত্বেরই অংশ। তবে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির দাবি করতে হলে, ঐতিহাসিকদের এইসব বীরভজনায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে; কারণ, তাঁর নিজ সংস্কৃতির ইতিহাসের নানা ছাঁদের ব্যাখ্যাকার হিসেবেই ঐতিহাসিকের বিশেষ গুরুত্ব নিহিত রয়েছে।’
রোমিলা থাপার-এর ‘অশোক ও মৌর্যদের পতন’ বইটির উপসংহার অংশের প্রথম প্যারাটিতে বর্ণিত এই অবস্থানটির প্রমাণ পাই বইটির প্রতিটি অধ্যায় জুড়ে। অশোক নিয়ে অসংখ্য মিথ, বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারকদের বিভিন্ন অতিমানবীয় বর্ণনার আচ্ছাদন কিংবা অশোকবিরোধীদের ঘৃণার প্রলেপ থেকে খুঁজে বের করে আনার চেষ্টা করেছেন ইতিহাসের সম্রাট অশোককে। অশোককে নিয়ে বিভিন্ন গল্প বা মিথ থেকে ইতিহাসের অশোককে আবিষ্কার করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জের কাজ যেকোন ঐতিহাসিকের জন্যই। বইটি পড়তে গিয়ে মিথের, গল্পের, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কেতাবে বর্ণিত অতিমানবীয় বা মহামানবীয় অশোকের যে বর্ণনা শুনে এসেছি বা পড়ে এসেছি তা বিভিন্ন জায়গায় প্রশ্নের মুখে, সন্দেহের মুখে পড়েছে।
পাঠকের বিশ্বাস ও পাঠকের প্রত্যাশা অনুযায়ী মসলা দেওয়া লেখকের বা ঐতিহাসিকের কাজ নয়। ইতিহাসের নির্মম ও নির্মোহ সত্য দিয়ে পাঠকের বিশ্বাসকে হুমকিতে ফেলে দিতে হবে, ধরে নেওয়া ইতিহাসকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে হবে, রূপকথা ও মিথ থেকে ছেঁকে আসল ইতিহাস বের করে আনার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
রোমিলা থাপার সে চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। বইটিতে সপ্তাহখানেক কাটানো অত্যন্ত লাভজনক বিনোয়োগ বলে মনে করছি। ইতিহাসের অশোককে জানা কম আনন্দদায়ক ছিলো না।
বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারের ইতিহাসে অশোক এমন একটি চরিত্র যেমনটা খ্রিষ্ট ধর্মের সাথে রোমান সম্রাট কনস্টানটাইনের। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি ধর্মের বিস্তার ও বিকাশের সাথে কোন সাম্রাজ্য, রাজ বা সম্রাট/মহারাজার সম্পর্ক রয়েছে। খ্রিস্ট ধর্মের সাথে রোমান সাম্রাজ্য ও কনস্টানটাইনের যেমন সম্পর্ক তেমনি বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের সাথে মৌর্য সাম্রাজ্য ও সম্রাট অশোকের নাম জড়িত।
আবার প্রতিটি ধর্মের ইতিহাসে আমরা দেখি এমন কিছু বড় বড় চরিত্র আছে যারা প্রথম জীবনে সেই ধর্মের নীতি বিরুদ্ধ কাজ করেন আবার সে নতুন ধর্ম গ্রহণ করে ভিন্নতর, মহত্তর মানবে পরিণত হয়ে যান। এবং সেই নতুন ধর্মের সবচেয়ে সেরা প্রচারকদের একজন হয়ে যান।
খ্রিস্ট ধর্মে আমরা এমন চরিত্র দেখি সেইন্ট পলের মধ্যে। যীশু খ্রিস্টের পর খ্রিস্ট ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই চরিত্র প্রথম জীবনে ডাকাত দলের সর্দার ছিলেন আর ছিলেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের উপর সবচেয়ে ভয়ানক নিপীড়কদের একজন। কিন্তু খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের পর তিনি হয়ে যান খ্রিস্ট ধর্মের সবচেয়ে সেরা ব্যাখ্যাকার, প্রচারক ও খ্রিস্ট ধর্মের প্রাতিষ্ঠানীকরণের নায়ক। মাইকেল এইচ হার্ট তার ‘দি হানড্রেড’ কেতাবে সন্দেহ প্রকাশ করেন যদি সেইন্ট পল খ্রিস্ট ধর্মকে নথিবদ্ধ না করতেন, প্রাতিষ্ঠানীকরণ না করতেন তাহলে আজকের বিশ্বের সবচেয়ে বেশী অনুসারীদের ধর্ম হতো না খ্রিস্টধর্ম। যীশু খুব অল্প বয়সে, ধর্ম প্রতিষ্ঠানকে গুছানোর আগেই ক্রসবিদ্ধ হন। তখন তার অনুসারী ছিল হাতেগোণা এবং অল্প কিছু অঞ্চলেই। সেইন্ট পল যীশুর ধর্মদর্শনকে নথিভুক্ত করেন, প্রাতিষ্ঠানীকরণ করেন, ধর্ম প্রচার, বিকাশ ও বিস্তারের সূচনা করেন।
ইসলাম ধর্মেও হযরত উমর (রা) এর কথা জানি। প্রথমজীবনে আরবের ভয়াবহ গুণ্ডা, বড় মদ্যপদের একজন এই যুবক মুহাম্মদ (স) কে হত্যা করার জন্য নাঙ্গা তলোয়ার হাতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু সেই লোকটিই পরবর্তী জীবনে নবী মুহাম্মদ ও ইসলামের সবচেয়ে ক্ষমতাধর চরিত্র হয়ে যান। নবী মুহাম্মদ স্বীকারও করেন তার পরে কেউ নবী হলে সেটা হতেন হযরত উমর। নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর ইসলামের সবচেয়ে প্রভাবশালী চরিত্র ছিলেন এই উমর যিনি প্রভাবিত করেছেন হযরত আবু বকর (রা) এর খলিফা হওয়ার বিষয়টি থেকে তাঁর (উমর) পর হযরত উসমানের খলিফা হওয়ার বিষয়টিও। আর দ্বিতীয় খলিফা থাকাকালে মুসলিম সাম্রাজ্য তার সোনালী সময়ে পৌছায় বলে ইসলামী ইতিহাসে লেখা আছে। তখনকার জানা পৃথিবীর অর্ধেক চলে এসেছিল নতুন এই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের পতাকাতলে।
বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারেও সম্রাট অশোক ও মৌর্য সাম্রাজ্যের এমন অবদান। এই সম্রাট কলিঙ্গ অভিযানে দেড় থেকে দুই লাখ কলিঙ্গবাসীকে হত্যা করেন এবং সমসংখ্যক কলিঙ্গবাসীদের বন্দি করেন ও দাসত্বের নিগড়ে বন্দি করেন। এই তিনিই আবার এমন একটি ধর্মের সবচেয়ে সেরা প্রচারক হন যার বিশ্বাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ‘জীবহত্যা মহাপাপ’। অসংখ্য মানুষ হত্যা হয়েছে যার হাতে সেই নৃপতিই আবার পরবর্তীতে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের প্রাণরক্ষায় ফরমান লিখতে থাকেন।
‘অশোক ও মৌর্যদের পতন’ বইটিতে রোমিলা থাপার ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের একটি প্রভাবশালী চরিত্র সম্রাট অশোককে মিথ, রূপকথা, উপকথার জাল থেকে সত্যিকারের অশোককে বের করে আনার চেষ্টা করেছেন। সম্রাট অশোককে আবিষ্কার বা তার বিস্তারিত পরিচয় জেনে এখনো সন্তুষ্ট হতে না পারলেও রোমিলা থাপারের প্রচেষ্টায় মুগ্ধ। ইতিহাস ও ইতিহাসের চরিত্রদের প্রতি কেমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আগানো উচিত তার একটা দীক্ষা লাভ হলো এই বইটিতে।
বি.দ্র: ছবিতে ‘অশোকা’ ছবির শাহরুখ খান। মুভি আকারে শাহরুখ খান ও কারিনা কাপুর অভিনীত ‘অশোকা’ মাঝারি মানের মনে হয়েছে। সিনেমার প্রয়োজনে অশোক চরিত্রের সাথে অনেক যোগ বিয়োগ হয়েছে। বইটি পড়তে গেলে অশোকা ছবির কথা মনে আসবেই। কিন্তু হতাশ হতে হবে ইতিহাসের অশোকার হুবহু মিল না দেখলে। মুভি বইটিকে আলাদা আলাদাভাবে টেক্সট হিসেবে পাঠ করাই নিরাপদ মনে হয়েছে আমার কাছে।
পড়তে পারেন
১. অশোক ও মৌর্যদের পতন-রোমিলা থাপার, অনুবাদ: সুভাষচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, প্রকাশক: কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী
২. দি হানড্রেড, মাইকেল এইচ হার্ট
Editor at thebdsf.com.
I read books to read people. And I write and talk about people.
Poetry is my passion, philosophy is my obsession, history is my lesson. Trying heart and soul to make Bangladesh Study Forum (BDSF) a hub for the youths of today who will determine the future course of this nation.
You can help me to enrich myself by sharing your best thoughts and suggestions here: sabidin.ibrahim@gmail.com
You can collect all of my books from Rokomari: www.rokomari.com/book/author/40494/সাবিদিন-ইব্রাহিম
Here are my social accounts where you can stay connected and share your opinions with me.